Read Aloud the Text Content
This audio was created by Woord's Text to Speech service by content creators from all around the world.
Text Content or SSML code:
পৃথিবীর যে দেশগুলিতে জলবায়ু জনিত কারণে স্থানচ্যূত মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, তারা হল চীন, ফিলিপিন্স, বাংলাদেশ আর ভারত। তাই আমাদের শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ক্রমশ ডুবতে থাকা সুন্দরবন অঞ্চল নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের সমস্যা সকলেরই জানা। আইলা-বুলবুল-আমফন-ইয়াস নিয়ে আমাদের বাস। তাই মানবাধিকারের খাতিরে জলবায়ু সমস্যার শিকার অগণন মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসন রাষ্ট্রের এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকেই ওঠা প্রয়োজন। দুখিনী সকিনা আর অন্ধ কুঞ্জভিখারী বাংলাদেশ থেকে আমফনের অব্যবহিত পরেই একটি রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছিল। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু মহিলারা। দুর্যোগ, বাস্তুচ্যুতি আর পরিযানের সময়ে কঠিনতম পরীক্ষা দিতে হয় প্রান্তিক মানুষদের, বৃদ্ধ-শিশু-নারীকে। এদের মধ্যে মহিলারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন, কারণ পরিবারের সেবার অলিখিত দায় তো তাঁদেরই। খাবার আর রসদের যোগানের অপ্রতুলতার অর্থ তাঁদের অনাহার বা অর্ধাহার। ফল অপুষ্টির দীর্ঘস্থায়ী ভীত আরো মজবুত হওয়া। তাছাড়া মহিলাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অন্যদিকগুলি প্রায় পুরোটাই উপেক্ষিত। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, আমফনের সময় প্রভাবিত মহিলাদের প্রায় ৫০% সন্তান ধারণের বয়ঃসীমার মধ্যে এবং ২৫% প্রকৃতই গর্ভবতী ছিলেন। এ ছাড়া রজঃস্বলা মহিলার সংখ্যা তো গোনাই হয় না। এইসব মেয়েলি সমস্যা স্বাভাবিক সময়েই গুরুত্ব পায় না। যেমন পায় না তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা। এর ওপরে আছে মেয়েদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রশ্ন। অনেক সময় ত্রাণ শিবিরগুলিই কমবয়সী মেয়েদের পক্ষে ভীতির কারণ হয়ে ওঠে। এইসব অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মেয়েদের দেহ ব্যবসায়ে যোগদানের ঘটনাও অজানা নয়। সুনামীর পরে তামিলনাড়ুতে এমন ঘটনার অনেক পরিসংখ্যান পাওয়া গিয়েছে। মহিলাদের স্বাস্থ্য ছাড়াও আছে শিক্ষাগত সমস্যা। যেমন দেখা যায়, বিপর্যয় মিটে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর যখন স্কুল খোলে, তখন প্রথমে পড়তে যায় বাড়ির ছেলেটি। ছোট মেয়েটি মায়ের সাথেই হয়তো রয়ে যায়। আর অন্য জায়গায় গিয়ে বাসা বাঁধলে হয়তো নতুন করে স্কুল খোঁজাই হয় না তার জন্য। লিখতে পড়তে না জানা মহিলারা অন্যভাবেও নিরুপায়। যেটুকু সরকারি সুযোগসুবিধা আছে, তাও সবসময় তাঁরা জানতে পারেন না, কাগজপত্র আর নিয়মকানুনের ভারে আবেদন করাই হয়ে ওঠে না। আমাদের মতো দেশে মহিলাদের অর্থনৈতিক মালিকানা কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা প্রায় নেই। দরিদ্র মানুষেরা বিপর্যয়ের ক্ষতি সামলাতে না পেরে অনেক সময়ই ছোটোখাটো জমিজমা, গরুছাগল ইত্যাদি বিক্রি করতে বাধ্য হন। একটু লক্ষ্য করলে লিঙ্গ বৈষম্যের চিত্রটি এ ক্ষেত্রেও দেখা যাবে। বর্তমান কালে এইসব পরিবারে মহিলাদের ওপর অর্থোপার্জনের দায় থাকে পূর্ণ মাত্রায়। অথচ দুর্দিনে সম্পত্তি বিক্রি করা বা অন্যান্য আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তাদের বিশেষ কোনো ভূমিকা থাকে না। বাংলাদেশে আমফন পরবর্তী সমীক্ষায় ৬৫% মহিলা সে রকম অভিজ্ঞতার কথাই জানিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশের সমস্যা, স্থানচ্যুতি বা পুরোপুরি স্থানান্তর, সবেতেই ভুক্তভোগী আমাদের অসহায় অগুনতি মহিলারা। তাই যখন “সর্বনাইস্যা ঘূর্ণি আইস্যা বিরান করল উড়ির চর, দুখিনী সকিনা কান্দে, কোথায় তাহার নতুন বর!” আমার গৃহসহায়িকা মেয়েটি এমনই এক সকিনা কিংবা সবিতা কিংবা সরলা। যে সমস্যাগুলি মহিলাদের জন্য বলা হলো, সেগুলির আরেক ভাগীদার গোষ্ঠী আছে, আমাদের প্রতিবন্ধী সহযাত্রীরা। মহিলাদের বিষয়ে কথাবার্তা আজকাল তবু শোনা যায়, বিভিন্ন নারী সংগঠন থেকে শুরু করে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মহিলা বিভাগ (UN Women) এই বিষয়ে সামান্য হলেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু যাঁদের কথা কোনো সরকারি দলিলে পৃথিবীর কোনো দেশেই পাওয়া যাবে না, তাঁরা হলেন প্রতিবন্ধী মানুষেরা। কোথায় যাবেন এঁরা, এঁদের ব্যবস্থা করবে কে, যখন দলে দলে মানুষ ঘর ছাড়েন? ভেঙে যাওয়া বাড়িঘর আর ভেসে যাওয়া ইস্কুল-কলেজ তাদের জীবনে শুধু সাময়িক নয়, অনেক সময়ই চিরকালীন। নতুন জায়গায় হয়তো আর তেমন ইস্কুল তৈরিই হবে না, যেমনটি ছিল আগের ভিটেয়। দুর্যোগের সময় কানে শুনতে না পাওয়া বা চোখে দেখতে না পাওয়া মানুষগুলোকে সরিয়ে নেওয়া কি গ্রাম পঞ্চায়েতের দায়িত্ব? আছে কি কোনো সরকারি লিখিত নিয়ম নির্দেশ? না। অন্ধ কুঞ্জ ভিখারীর বাস ছিল যে গ্রামের এক কোনায় জীর্ন ফাটল ধরা পোড়ো মন্দিরের গায়ে, সেটা নতুন জায়গায় তাকে খুঁজে দেবে কে? যারা নিজেরারই স্থিতি হারিয়ে দিশাহারা, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানহারা? হয়তো বা তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেই ভুলে যাবে পড়শীর দল। আর যদি এই প্রতিবন্ধীদের মধ্যে কেউ হন মহিলা, তবে তাঁর সমস্যা দ্বিগুণ। নীতিগত আর আইনী ব্যবস্থার দাবি আজ পর্যন্ত প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন নিয়ে কোনো পরিবেশ নীতি বা জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নীতিতে কোনো ব্যবস্থা হয় নি। উন্নয়শীল দেশে এমনিতেই হাজারো সমস্যা। তার ওপরে আরো মাত্রা যোগ করলে দেশের পরিচালকরা সামলাবেন কী করে? তাই এই বিষয়টি উপেক্ষিত। সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে পরিবেশ বা জলবায়ু পরিবর্তন সম্বন্ধিত নীতিতে নারী এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নীতি নেই। শুধু এই অঞ্চলেই নয়, পৃথিবীর তাবৎ দেশেই এমন নীতি তৈরি হোক, সোচ্চারে সেই দাবি জানাই। এর জন্য চাই সচেতনতা, হোক প্রচার, প্রয়োজনে হোক আন্দোলন। সরকারি নীতিনিয়ামকরা বাধ্য হোন নতুন নিয়ম গড়তে, যেখানে সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন মানে সব প্রান্তিক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত। সেখানে লিঙ্গ আর প্রতিবন্ধীত্বের অবহেলিত মাত্রাগুলি যুক্ত হোক, তাদের নিরাপত্তা আর ভবিষ্যৎ পুনর্বাসনের জন্য ব্যবস্থা থাকুক। গরীব দেশের এই প্রয়োজন পৃথিবীর তাবৎ রাষ্ট্রের পরিবেশ নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হোক। জলবায়ু পরিবর্তনের অসহায় শিকার দরিদ্র জনসমষ্টির জীবনমরণ সমস্যার জন্য উপযুক্ত সমাধান তৈরি হোক। আর তাদের মধ্যে যারা আরো বেশি উপেক্ষিত, সেই নারী ও প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ জলবায়ু পরিবর্তন নীতি আশু নির্ধারিত হোক, আজকের পরিবেশ নামাঙ্কিত বিশেষ দিনটিতে এই দাবিটুকুই রইল।